হুজুর গওসে আযম এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
হুজুর গওসে আযম এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
মাওলানা ইসমাইল শেখ মিসবাহী
গওসে আযম একজন উদার, সদালাপী, নিচু স্বভাবের, শুদ্ধ, ন্যায়পরায়ণ, সত্যবাদী, সাহসী, মহা জ্ঞানী, দানশীল, খোদাভীরু ও দয়ালু মানুষ ছিলেন।
তিনি একজন আল্লাহর কামিল ওলি ছিলেন, তিনি অনেক ইহুদি খ্রিস্টান ও মুশরিকদেরকে মুসলমান করেছিলেন।
জন্ম ও পরিচয়: হুজুর গওসে আযম ইরান প্রদেশের জিলান শহরের নিফা অথবা এলাক নামক গ্রামে ( ৪৭০ হিজরি মোতাবেক ১০৭৭ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন)
তিনার মূল নাম- সৈয়দ আব্দুল কাদের জিলানী উপনাম- আবু মোহাম্মদ উপাধি-
মহিউদ্দিন ও মাহবুবে সুবহানি ইত্যাদি রহিমাহুল্লাহ
তিনার পিতার নাম- আবু সালেহ মুসা জাংগী
দাদা -হযরত আব্দুল্লাহ রহিমাহুমাল্লাহ তিনার মাতার নাম- উম্মুল খায়ের আমাতুল জাব্বার ফাতেমা রাহিমাহাল্লাহ তিনার নানার নাম- সুফী আব্দুল্লাহ সুমাইয়ী রাহিমাহুল্লাহ।
বংশ তালিকা: পিতার দিক দিয়ে বংশ তালিকা হযরত হাসান রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর সাথে মিলে যায় আর মাতার দিক দিয়ে হযরত হোসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুর সাথে মিলে যায় তাই তিনাকে "نجيب الطرفين" বলা হতো।
শিক্ষা জীবন: হুজুর গওসে আযম যখন জানলেন যে ,প্রত্যেক মুসলমান এর জন্য জ্ঞান অর্জন করা ফরজ তখন তিনি আলেমদের কাছে শিক্ষা অর্জনের জন্য যেতে লাগলেন। কোরআন শরীফ শিক্ষা অর্জন করার পর তিনি ১৭ বছর বয়সে উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে মায়ের আদেশানুসারে ইরাকের বাগদাদ শহর রওনা হন। তিনি নিম্নলিখিত আলেমদের কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করেছেন।
১. আবুল অফা আলী বিন আকিল ২. আবুল খেতাব মাহফুজ আল কালুজানী হাম্বালি ৩. আবুল হাসান মোহাম্মদ বিন কাজী ৪. আবু সাঈদ আল মোবারক ৫. আলী আবু জাকারিয়া ইয়াহিয়া বিন আলী তাবরেজি ৬. আবুল গালেব মোহাম্মদ বিন হাসান ৭. আবু সাঈদ মোঃ বিন আব্দুল কারিম ৮. আবু নাসর মোহাম্মদ ৯. আবু গালেব আহমদ। এছাড়া আরও বিখ্যাত বিখ্যাত আলেমদের কাছে তিনি জ্ঞান অর্জন করেছেন।
কর্মজীবন: ১.উলুমে জাহিরি ও উলুমে বাতিনি সম্পূর্ণ করার পর তিনি শিক্ষা দীক্ষা ও ওয়াজ নসিহত এর কাজ আরম্ভ করেন। তিনার ওয়াজ এর মজলিসে ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষ বসতেন ।তিনি জুম্মার দিন সকালে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মাদ্রাসার মধ্যে এবং রবিবার সকালে দরগা আলিয়া এর মধ্যে ওয়াজ করতেন তিনার মাহফিলে প্রত্যেক ধর্মের মানুষ উপস্থিত থাকতো যেমন মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, ইহুদি ইত্যাদি চারশো এর অধিক আলিম ওলামা তিনার মূল্যবান কথা লেখার জন্য উপস্থিত থাকতেন।
২. হুজুর গওসে আযম একজন দানশীল ব্যক্তি ছিলেন। একদা হজ্ব করতে বার হলেন বাগদাদের হিরা নামক স্থানে পৌঁছালেন তিনি জিজ্ঞাসা করলেন এই গ্রামে সবচাইতে গরিব কে আছে? জানার পর ওই গরিবের বাড়িতে অবস্থান করলেন এই খবর পেয়ে অনেক নেতা এবং ধনী ব্যক্তি অধিক পরিমাণে তোহফা ও টাকা পয়সা হুজুরের দরবারে নিয়ে আসলেন হুজুর সবকিছু ওই গরিব ব্যক্তিকে দিয়ে দিলেন। তারপর সেখান থেকে চলে গেলেন পরে জানা গেল যে ওই গরিব ব্যক্তি ধন-সম্পদ পাওয়ার পর গ্রামের মধ্যে সবচাইতে ধনী হয়ে গেছে।
৩. তিনি অনেক দয়ালু ছিলেন ক্ষুধার্ত ব্যক্তিদের খাবার খাওয়াতেন। অভাবীদের প্রয়োজনে তিনি বিপুল সম্পদ ব্যয় করতেন
।তিনার বাড়িতে সাধারণ মানুষের জন্য সর্বদা খাবার রান্না করা হতো এবং বলা হতো যার ইচ্ছা এখান থেকে খাবার নিয়ে যাও এবং বাড়ির মধ্যে আরাম করার ব্যবস্থাও থাকতো সাধারণ মানুষের জন্য।
বিবাহ ও সন্তান-সন্ততি: শাহাবুদ্দিন তাঁর কিতাব আওয়ারিফুল মাআরিফে বর্ণনা করেছেন হুজুর বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানী দীনের খেদমতে ব্যস্ত থাকার কারণে বিবাহ করাটাকে ভয় করতেন পরে তিনি জীবনে চারটি বিবাহ করেছিলেন তেনার মোট সন্তান সন্ততি ৪৯ জন তার মধ্যে ২০টি পুত্র আর বাকি কন্যা তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সন্তানের নাম নিম্নে লেখা হল। ১. শায়েখ আব্দুল ওহাব ২. শায়েখ আব্দুর রাজ্জাক ৩. শায়েখ আব্দুল আজিজ ৪. শায়েখ আব্দুল্লাহ ৫. শেখ আব্দুল জাব্বার ৬. শায়েখ মোহাম্মদ ঈসা ৭. শায়েখ ইয়াহইয়া ৮.শায়েখ ঈসা ৯. শায়েখ ইব্রাহিম রহিমাহুমুল্লাহ।
*মূল্যবান কথা:*১.হুজুর গওসে আযম বলেছেন প্রত্যেক মুসলমানের উচিত তার যা কিছু আছে তার জন্য তাতেই জীবন ব্যয় করার চেষ্টা করা এবং হারাম ও অবৈধ উপায়ে দুনিয়ার বিলাসিতা অর্জন না করা।২.প্রত্যেক মুসলমান তার বিষয়ে একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করুক এবং কঠোর পরিশ্রম, কৌশল বা মানুষকে সাফল্যের মাধ্যম মনে না করুক। ৩.মুসলমানদের উচিত ধৈর্য ধারণ করা এবং প্রতিটি কষ্ট সহ্য করা।৪.একজন মুসলমানকে খেয়াল রাখতে হবে যে সে যা কিছু করে তা আল্লাহকে খুশি করার জন্য মানুষকে খুশি করার জন্য নয়।
অলৌকিক ঘটনা: ১. হুজুর গওসে আযম সত্যবাদী ছিলেন সর্বদা সত্য কথা বলতেন একদা তিনি হজ্ব করতে যাচ্ছিলেন কিছু মানুষের সাথে রাস্তায় ডাকাতরা সবার সামানপত্র চুরি করে নিলো আর হুজুরকে গরিবের সন্তান মনে করে ছেড়ে দিল। একজন মজাক করে জিজ্ঞাসা করল তোমার কাছে কিছু আছে? হুজুর গওসে আযম বললেন আমার কাছে ১৮ টা মুদ্রা আছে ডাকাতরা হাঁসতে লাগলো একজন তাঁর সামানপত্র খোঁজাখুঁজি করলো কিন্তু মুদ্রা পেল না ডাকাতদের নেতা বলল আমার সাথে মজাক করছো? হুজুর গওসে আযম বললেন আমি মজাক কাকে বলে জানিনা আবার খোঁজার পরে ডাকাতরা মুদ্রা পেলো সবাই আশ্চর্য হয়ে গেল ডাকাতের নেতা বলল তুমি তো মুদ্রা লুকিয়ে রাখতে পারতে আমাদেরকে না জানিয়ে। তিনি বললেন, আমি মিথ্যা কথা বলি না আমি আমার আম্মাজান এর কাছে অঙ্গীকার করেছি যে, আমি কখনো মিথ্যা কথা বলব না যদি ও আমার প্রাণ চলে যায়। হুজুরের কথা শুনে সবাই কান্না করতে লাগলো এবং অন্তর থেকে তওবা করলেন।
২.হুজুর গওসে আযম রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু ১লা রমযান জন্মগ্রহণ করার কারণে গোটা রমযান মাস দিনের বেলায় মায়ের দুধ পান করতেননা বরং ইফতারের সময় দুধ পান করতেন। ৪. হুজুর গওসে আযম রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু একজন জন্মগত ওলী ছিলেন এই কারণে তিনি শৈশব কালেও খেলাধুলা করতেন না। ৫. বড় পীর হুজুর গওসে আযম রাদ্বিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর ঘাম মোবারক থেকে সুগন্ধি বের হতো। ৬. হুজুর গওসে আযম রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর আওয়াজ মোবারক নিকট ও দূরের মানুষ সমানভাবে শুনতে পেত।
গ্রন্থাবলি: হুজুর গওসে আযম একজন অন্যতম লেখক ছিলেন অনেক বিষয়ে পন্ডিত ছিলেন ।তিনি অনেক গ্রন্থ লিখেছেন তিনার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ নিম্নে লেখা হলো ১.আল গুনিয়াতু লি তলিবীল হক্ব ২.আল মাওয়াহিবুর রহমানিয়া ওয়া ফুতুহাতুর রব্বানীয়া ৩.তাফসিরুল কোরআন ওয়াল মাখতুতাহ ৪.তামবিহুল গাবী ইলা রেওয়ায়াতি আন নবী ৫.জালাউল খাতির ৬.হিজবু বাশায়ীরিল খয়রাত ৭.ফুতুহুল গায়িব ৮.রেসালাতুল ওসিয়্যাহ ৯.মানাকিবুল জিলানী ইত্যাদি।
মৃত্যু: হুজুর গওসে আযম রহিমাহুল্লাহ বাগদাদ শহরের ২৫ শাওয়াল ৫৯৩ হিজরী তে সন্ধ্যার সময় মৃত্যুবরণ করেন এবং সেখানেই তিনাকে হিলিয়া নামক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
অথবা ৫৬১ হিজরী ১১ অথবা ১৭ রবিউস সানি সোমবার রাতে এশার নামাজ পর বাগদাদ শরীফ এর মৃত্যুবরণ করেন ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
বড় পীর আব্দুল কাদের জিলানীর তৈরি করা মাদ্রাসা আলীয়া লাগোয়া ইরাকের রাজধানী বাগদাদে তাঁর মাজার শরীফ রয়েছে।
Comments -