নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কী নিজের জন্মদিন পালন করেছেন? জন্মদিন পালন সুন্নাত নাকি বিদ'আত?
🏵️ নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কী নিজের জন্মদিন পালন করেছেন? 🏵️
সম্মানিত সুধী! মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সময় সন্নিকটে আসলেই বহু মানুষ এই প্রশ্ন উত্থাপন করে থাকে যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি নিজের জন্মদিন পালন করেছেন? সহীহ সুন্নাহর আলোকে উত্থাপিত প্রশ্নটির পর্যালোচনা করলে পরিস্কার প্রতীয়মান হয় যে, হ্যাঃ প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বহু বার নিজের জন্মদিন পালন করেছেন। এ প্রসঙ্গে কিছু হাদীস নিম্নে প্রদত্ত হলো-
عَنْ أَبِي قَتَادَةَ الأَنْصَارِيِّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سُئِلَ عَنْ صَوْمِ الاِثْنَيْنِ فَقَالَ: ((فِيهِ وُلِدْتُ وَفِيهِ أُنْزِلَ عَلَيَّ)).
অর্থাৎ- হযরত আবু কাতাদা আনসারী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম কে সোমবারের রোজা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি উত্তরে বললেন, আমি সোমবার জন্মগ্রহণ করেছি এবং সোমবার দিনে আমার প্রতি প্রথম ওহী নাযিল হয়েছে।
{{ সহীহ মুসলিম হাদীস নং-২৮০৭,, মুসনাদ আহমাদ হাদীস নং-২২৫৫০,, সুনানে কুবরা বাইহাকী ৪/৪৮৪ হাদীস নং-৮৪৩৪,, শুয়াবুল ঈমান বাইহাকী ২/৫০১২ হাদীস নং-১৩২৩,, মিশকাতুল মাসাবীহ হাদীস নং-২০৪৫ }}
(( উক্ত হাদিসটি বিশুদ্ধ ও সহীহ সনদ বর্ণিত হয়েছে ))
✴️উপরোক্ত হাদীস থেকে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু তায়ালা আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি সপ্তাহের সোমবার দিন রোজা রাখতেন এবং সাহাবায়ে কেরাম যখন তাঁকে সেই রোজা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করেন, তখন তিনি উত্তরে বললেন, আমি সেইদিন এজন্য রোজা রাখি কারণ সেই দিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি। সুতরাং এখান থেকে প্রমাণিত হয় যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজের জন্মদিন কে পালন করতেন রোজার মাধ্যমে।
জন্মদিন পালন করা যদি অবৈধ ও নাজায়েজ হত তাহলে নবীজি সাল্লাল্লাহু সাল্লাম কোনদিন নিজের জন্মদিন পালন করতেন না।
✴️উল্লেখ্য যে, কোন জিনিসকে পালন ও সেলিব্রেট করার জন্য ঢল-তবলা, নাচ-গান ও নাজায়েজ কর্ম হওয়াটা জরুরী নয় বরং ভালো এবং নেক কাজের মাধ্যমেও মুসলিম উম্মাহ বহু বিষয় ও দিবস পালন করে থাকে। যেমন-
ঈদুল ফিতরের দিনকে আমরা পালন করি নামাজের মাধ্যমে, ঈদুল আযহাকে পালন করি নামাজ ও কুরবানীর মাধ্যমে, রমজান মাসকে পালন করি রোজা ও তারাবীহের মাধ্যমে, মহরমের আশুরা পালন করি রোজা অথবা নামাজের মাধ্যমে, লাইলাতুল ক্বাদরকে পালন করি আল্লাহর এবাদত ও নফল নামাজের মাধ্যমে, হজ্ব পালন করি তাওয়াফ ও সায়ী ইত্যাদির মাধ্যমে। সুতরাং কোন দিন কে পালন করা অথবা সেলিব্রেট করার জন্য নাজায়েজ ও অবৈধ কাজ হতে হবে এমনটা জরুরী নয় বরং জায়েজ ও নেক কাজের মাধ্যমেও পালন করা যায়।
উপরোক্ত হাদীসের মাধ্যমে এটাও সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, "ইসলাম ধর্মে জন্মদিন পালন করার কোনো সুযোগ নেই" একথা নিছক ভুল ও ভিত্তিহীন। কারণ যেখানে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই জন্মদিন পালন করেছেন সেখানে "ইসলাম ধর্মে জন্মদিন পালন করা বৈধ নয়" একথা কোনো মুসলিমের জন্য বলা ও ব্যক্ত করা উচিত হবে না। তবে হ্যাঁ নিজ অথবা পরিবারের যে কোন ব্যক্তির জন্মদিন পালন করার সময় এ বিষয়টি অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে যে, জন্মদিন পালন যেন কোন নাজায়েজ ও অবৈধ কর্মের মাধ্যমে না হয়, আর না এমন কাজের মাধ্যমে জন্ম দিন পালন করা বৈধ হবে যে কাজটি কোন অমুসলিম সম্প্রদায়ের ধার্মিক কাজের সঙ্গে সাদৃশ্যতা রাখে। মূল কথা হলো জায়েজ ও নেক কাজের মাধ্যমে জন্মদিন পালন করা স্বীয় নবী করীম সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম এর সুন্নত অতএব এটাকে অবৈধ অথবা বিদয়াত বলে আখ্যায়িত করা মুর্খামি ছাড়া অন্য কিছু হবে না। এ প্রসঙ্গে আরো কিছু দলিল নিম্নে প্রদত্ত হলো-
ﻋﻦ ﻋﺒﺪ اﻟﻠﻪ ﺑﻦ ﻣﺤﺮﺭ، ﻋﻦ ﻗﺘﺎﺩﺓ، ﻋﻦ ﺃﻧﺲ ﻗﺎﻝ: «ﻋﻖ ﺭﺳﻮﻝ اﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ اﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻋﻦ ﻧﻔﺴﻪ ﺑﻌﺪ ﻣﺎ ﺑﻌﺚ ﺑﺎﻟﻨﺒﻮﺓ»
অর্থাৎ- হযরত আনাস বিন মালিক রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়াত প্রকাশের পর নিজের জন্য আকিকা করলেন।
{{মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক খন্ড-4 পৃষ্ঠা-339 হাদিস নং-7960 }}
عن أنس قال ﻋﻖ ﺭﺳﻮﻝ اﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ اﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻋﻦ ﻧﻔﺴﻪ ﺑﻌﺪ ﻣﺎ ﺟﺎءﺗﻪ اﻟﻨﺒﻮﺓ
অর্থাৎ- হযরত আনাস বিন মালিক রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু সাল্লাম নাবুওয়াত প্রকাশের পর নিজের তরফ থেকে আকিকা করলেন।
{{ শারফুল মুস্তাফা খন্ড-6 পৃষ্ঠ-240 হাদিস নং- 1859 }}
ﻋﻦ ﺃﻧﺲ ﺃﻥ اﻟﻨﺒﻲ - ﺻﻠﻰ اﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ - «ﻋﻖ ﻋﻦ ﻧﻔﺴﻪ ﺑﻌﺪﻣﺎ ﺑﻌﺚ ﻧﺒﻴﺎ».
ﺭﻭاﻩ اﻟﺒﺰاﺭ، ﻭاﻟﻄﺒﺮاﻧﻲ ﻓﻲ اﻷﻭﺳﻂ، ﻭﺭﺟﺎﻝ اﻟﻄﺒﺮاﻧﻲ ﺭﺟﺎﻝ اﻟﺼﺤﻴﺢ ﺧﻼ اﻟﻬﻴﺜﻢ ﺑﻦ ﺟﻤﻴﻞ، ﻭﻫﻮ ﺛﻘﺔ
অর্থাৎ- হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু হতে বর্ণিত। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম নবুয়ত প্রকাশের পর নিজের তরফ থেকে আকিকা করেন।
{{ মাজমাউজ জাওয়ায়েদ খন্ড-4 পৃষ্ঠা-59 হাদিস নং-6203 }}
🔘 ইমাম হাইসামী রহমতুল্লাহি আলাইহির উপরোক্ত হাদীসটি উল্লেখ করার পর বলেন- ইমাম বাজ্জার ও তাবরানী রাদিয়াল্লাহু আনহুমা উক্ত হাদীস কে বর্ণনা করেছেন আর হাদীসের রাবী গণের মধ্যে হাইসাম বিন জামীল ব্যতীত তাবরানী শরীফ এর সমস্ত রাবীগণ বিশ্বস্ত ও সেক্বা। তবে তিনি সমালোচিত হলেও বহুজনের নিকট তিনিও বিশ্বস্ত। ( সুতরাং হাদীসটি কমপক্ষে হাসান বলে গণ্য হবে।)
✴️ প্রিয় মুসলিম সমাজ! উপরোল্লেখিত তিনটি হাদীস শরীফ থেকে প্রমাণ হয় যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চল্লিশ বছর পর নিজের তরফ থেকে আকীকা করে মানুষকে খাইয়েছেন।
উপরোক্ত এই তিন হাদীস এর মর্মার্থ জানার ও বুঝার জন্য আমাদেরকে জানতে হবে যে, আকিকা করা সন্তান জন্মের কয়দিন পর সুন্নত এবং আকিকা কেন করা হয়?
আকিকা করা কোন দিন সুন্নত এ প্রসঙ্গে মুহাদ্দিসগনের যদিও মতভেদ রয়েছে তবে তন্মধ্যে সর্বোত্তম মত হল বাচ্চা ভূমিষ্ঠের সপ্তম দিনে আকিকা করা সুন্নত। দ্বিতীয়তঃ আকিকা করা হয় বাচ্চা জন্মের খুশি পালন করার উদ্দেশ্যে, মানুষকে পশু জবাই করে খাওয়ানোর মাধ্যমে। আর একথা প্রমাণিত যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পিতামহ আব্দুল মুত্তালিব তাঁর জন্য আকিকা করেছিলেন যা নিম্নোক্ত হাদীস হতেও প্রতীয়মান হয়,
ﻭﺃﺧﺮﺝ اﺑﻦ ﻋﺴﺎﻛﺮ ﻋﻦ اﺑﻦ ﻋﺒﺎﺱ ﻗﺎﻝ ﻟﻤﺎ ﻭﻟﺪ اﻟﻨﺒﻲ ﺻﻠﻰ اﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻋﻖ ﻋﻨﻪ ﻋﺒﺪ اﻟﻤﻄﻠﺐ ﺑﻜﺒﺶ ﻭﺳﻤﺎﻩ ﻣﺤﻤﺪا ﻓﻘﻴﻞ ﻟﻪ ﻳﺎ ﺃﺑﺎ اﻟﺤﺎﺭﺙ ﻣﺎ ﺣﻤﻠﻚ ﻋﻠﻰ ﺃﻥ ﺳﻤﻴﺘﻪ ﻣﺤﻤﺪا ﻭﻟﻢ ﺗﺴﻤﻪ ﺑﺎﺳﻢ ﺁﺑﺎﺋﻪ ﻗﺎﻝ ﺃﺭﺩﺕ ﺃﻥ ﻳﺤﻤﺪﻩ اﻟﻠﻪ ﻓﻲ اﻟﺴﻤﺎء ﻭﻳﺤﻤﺪﻩ اﻟﻨﺎﺱ ﻓﻲ اﻷﺭﺽ
অর্থাৎ- হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন তাঁর পিতামহ আল্দুল মুত্তালিব তাঁর আকীকা করেন এবং নাম রাখেন মুহাম্মাদ। তাকে জিজ্ঞেস করা হল, তুমি তাঁর নাম মুহাম্মাদ কেন রাখলে আর তোমার পূর্ব পুরুষদের নামে নাম রাখলে না কেন? প্রদত্তরে তিনি বললেন, আমি ইচ্ছা করলাম, আল্লাহ তা'আলা যেন আসমানে তাঁর প্রশংসা করেন এবং লোকজন যেন পৃথিবীতে তাঁর প্রশংসা করেন।
{{ ইবনে আসাকির 3/32,, খাসাইসে কুবরা 1/134,, জামিউল আহাদিস হাদিস নং-39107,, মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া 1/442,, শারহুয যুরকানী আলা মুআত্তা 4/691,, মিনারুল কারী 4/236 }}
উপরোক্ত হাদীস হতে প্রতীয়মান হয়েছে যে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আকিকা পূর্বেই হয়েছিল, অতএব দ্বিতীয়বার পরিভাষিক আকিকা করার কোন অর্থই হয় না। সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চল্লিশ বছর পর নিজের নাম রাখার জন্য আকিকা করেননি বরং নিজের জন্মের খুশি পালন করার উদ্দেশ্যেই পশু জবাই করে সাহাবাদের খাইয়েছেন। অতএব মিলাদুন্নবী তথা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শুভাগমনের খুশি প্রকাশ করা ও পশু জবাই করে মানুষদের আহার করানো এটাও হাদীস দ্বারা সুস্পষ্ট ভাষায় প্রমাণিত হয়।
✍️ মুফতী আমজাদ হুসাইন সিমনানী সাহেব
🌍কুশমন্ডি, দক্ষিণ দিনাজপুর, পশ্চিমবঙ্গ,🌍
Comments -