কুরবানীর চাঁদ উঠার পর কি চুল ও নখ কাটা যাবে না?
কুরবানীর চাঁদ উঠার পর চুল ও নখ কর্তন করা যাবে কিনা ?
🌼প্রশ্ন:-👉 ক্বোরবানীর চাঁদ উঠার পর কি চুল ও নখ কাটা যাবে না?
🌺উত্তর:-✍️ যে ব্যক্তি ক্বোরবানী করার নিয়ত করবে তার পক্ষে ক্বোরবানী না করা পর্যন্ত চুল, নাভীর নিচের পশম এবং নখ কাটা থেকে বিরত থাকা হল মুস্তাহাব বা উত্তম। তবে উক্ত মুস্তহাব নির্দেশিকার প্রতি তখন আমল করা যাবে, যখন ক্বোরবানী করা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে গিয়ে নাভীর নিচের পশম এবং নখ কাটার সময়সীমা চল্লিশ দিনের অতিরিক্ত না হয়। আর যদি এ বিধানের উপর আমল করতে গিয়ে নাভীর নিচের পশম এবং নখ কাটার সময়সীমা চল্লিশ দিনের অতিরিক্ত হয়, তাহলে উক্ত বিধানের প্রতি আমল করা যাবে না। কারণ, চল্লিশ দিনের মধ্যে নাভীর নিচের পশম, নখ এবং বগলের চুল কাটা জরুরী। চল্লিশ দিন অতিক্রম করা নাজায়েয ও মাকরূহ তাহরীমী। ফলে মুস্তাহাব কর্মের প্রতি আমল করতে গিয়ে মাকরূহ তাহরীমী'র সাথে জড়িত হওয়া নিষিদ্ধ ও নাজায়েয।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
مَن كانَ له ذِبْحٌ يَذْبَحُهُ فإذا أُهِلَّ هِلالُ ذِي الحِجَّةِ، فلا يَأْخُذَنَّ مِن شَعْرِهِ، ولا مِن أظْفارِهِ شيئًا حتَّى يُضَحِّيَ.
অনুবাদ:- যে লোকের কাছে ক্বোরবানীর পশু আছে সে যেন যিলহজ্জ (কুরবানীর) মাসের নতুন চাঁদ দেখার পর ঈদের দিন থেকে ক্বোরবানির করা পর্যন্ত তার চুল ও নখ না কাটে। ( মুসলিম শরীফ, হাদীস: 5015)
রাদ্দুল মুহতার নামক কিতাবে রয়েছে-
فھذا محمول علی الندب بالاجماع
অর্থাৎ:- ইজমা তথা সর্বসম্মত অভিমত অনুযায়ী এ হুকুম টি হল মুস্তাহাব। (রাদ্দুল মুহতার, খন্ড: 1, পৃষ্ঠা: 565)
عَنْ أُمِّ سَلَمَةَ قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللّهِ ﷺ: إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ وَأَرَادَ بَعْضُكُمْ أَنْ يُضَحِّيَ فَلَا يَمَسَّ مِنْ شَعْرِه وَبَشَرِه شَيْئًا وَفِي رِوَايَةٍ فَلَا يَأْخُذَنَّ شَعْرًا وَلَا يَقْلِمَنَّ ظُفْرًا وَفِي رِوَايَةٍ مَنْ رَأَى هِلَالَ ذِي الْحِجَّةِ وَأَرَادَ أَنْ يُضَحِّيَ فَلَا يَأْخُذْ مِنْ شَعْرِه وَلَا مِنْ أَظْفَارِه . رَوَاهُ مُسْلِمٌ
অনুবাদ:- হযরত উম্মে সালামাহ্ রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যখন যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশক শুরু হয়ে যায় আর তোমাদের কেউ কুরবানী করার ইচ্ছা করে, সে যেন নিজের চুল ও চামড়ায় মোটেই হাত না দেয়। অন্য এক বর্ণনায় আছে, সে যেন কেশ স্পর্শ না করে ও নখ না কাটে। অপর এক বর্ণনায় আছে, যে ব্যক্তি যিলহজ্জ মাসের নব চাঁদ দেখবে ও কুরবানী করার নিয়্যাত করবে সে যেন নিজের চুল ও নিজের নখগুলো কর্তন না করে। {মিশকাত শরীফ, হাদীস: 1459, মুসলিম: হাদীস: 1977, নাসায়ী 4364, ইবনু মাজাহ্, হাদীস: 3149, আহমাদ, হাদীস: 26474, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী, হাদীস: 19043, শু‘আবুল ঈমান, হাদীস: 6948, ইরওয়া, হাদীস: 1163, সহীহ আল জামি, হাদীস: 520}
উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় মুফারসিরে ক্বোরআন, হাকীমুল উম্মত হযরত আল্লামা মাওলানা মুফতী আহমদ ইয়ার খাঁন নাঈমী রহমতুল্লাহি তা'আলা আলাইহি বলেছেন:
"অর্থাৎ যে ধনী ওয়াজিব হিসেবে কিংবা দরিদ্র নফল হিসেবে ক্বোরবানী করার ইচ্ছা করে, সে ক্বোরবানির ঈদের চাঁদ দেখা থেকে ক্বোরবানি করা পর্যন্ত নখ,চুল এবং শরীরের মৃত চামড়া ইত্যাদি না নিজে কাটবে, না কারো দ্বারা কাটাবে; যাতে হাজীদের সাথে কিছুটা হলেও সাদৃশ্য হয়ে যায়। কেননা, তারা ইহরামে ক্ষৌরকর্ম করাতে পারেন না এবং যেন ক্বোরবানির প্রতিটি চুল ও নখের ফিদিয়া (বিনিময়) হয়ে যায়। এ হুকুম মুস্তাহাব নির্দেশক; ওয়াজিব (অনিবার্য) নির্দেশক নয়। সুতরাং ক্বোরবানিদাতার জন্য ক্ষৌরকর্ম কর্ম না করানো উত্তম, আবশ্যকীয় নয়। এ থেকে বুঝা গেল যে, উত্তম লোকদের সাথে সাদৃশ্য রাখাও উত্তম।
(মিরআতুল মানাজীহ শারহে মিশকাতুল মাসাবীহ (বাংলা), খন্ড: 2, পৃষ্ঠা: 445,446)
আলা হযরত রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেছেন:
"এ হুকুম টি হল শুধুমাত্র মুস্তাহাব বা উত্তম। করলে ভালো। না করলে কোন ক্ষতি নেই। একে না ফরমানি বলা যাবে না আর না ক্বোরবানীতে কোন ক্ষতি হবে। বরং যদি কেউ ৩১ দিনের মধ্যে কারণবশত অথবা অকারণে নখ ও চুল না কেটে থাকে আর যিলহজ্জ মাসের চাঁদ উঠে গেল, তাহলে যদিওবা সে ক্বোরবানীর ইচ্ছা রাখে, এ মুস্তাহাব (বিধানের) -এর প্রতি আমল করতে পারবে না। কেননা, এখন দশ দিন পর্যন্ত রাখলে নখ কাটার এবং চুল কাটার ৪১ দিন হয়ে যাবে। আর চল্লিশ দিনের অতিরিক্ত (নখ ও নাভির নিচে চুল) না কাটা গুনাহ। মুস্তাহাব কর্মের জন্য গুনাহ করতে পারবে না"
(ফাতাওয়া রাযাবীয়াহ, খন্ড 20 পৃষ্ঠা 353-354, প্রকাশিত রেযা একাডেমী, মুম্বাই)
ক্বোরবানী না করেও ক্বোরবানীর নেকী অর্জন করা যায়:
সর্বশেষ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তিকে বললেন :
أُمِرْتُ بِيَوْمِ الأَضْحَى عِيدًا جَعَلَهُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ لِهَذِهِ الأُمَّةِ " . فَقَالَ الرَّجُلُ أَرَأَيْتَ إِنْ لَمْ أَجِدْ إِلاَّ مَنِيحَةً أُنْثَى أَفَأُضَحِّي بِهَا قَالَ " لاَ وَلَكِنْ تَأْخُذُ مِنْ شَعْرِكَ وَتُقَلِّمُ أَظْفَارَكَ وَتَقُصُّ شَارِبَكَ وَتَحْلِقُ عَانَتَكَ فَذَلِكَ تَمَامُ أُضْحِيَتِكَ عِنْدَ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ "
অনুবাদ:- ক্বোরবানীর দিনকে ঈদের দিন করার জন্য আমাকে আদেশ করা হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা এই উম্মতের জন্য একে সাবস্ত্য করেছেন। তখন ঐ ব্যক্তি বললো: যদি আমি দুধপান করার জন্য অন্যের দান করা পশু ব্যতীত অন্য কিছু না পাই, তা হলে কি আমি তা-ই ক্বোরবানী করব? তিনি বললেন: না, কিন্তু তুমি (নামাযের পর) তোমার চুল, নখ কেটে ফেলবে এবং গোঁফ ছোট করবে এবং তোমার নাভীর নিচের পশম কামাবে; এটাই হবে আল্লাহ্র নিকট তোমার ক্বোরবানীর পূর্ণতা।
(সুনানে আন-নাসায়ী, হাদিস: 4365)
উক্ত হাদীস উল্লেখ করার পর হুযূর সাদরূশ শারীয়াহ রহমতুল্লাহি তা'আলা আলাইহি বলেন:
"যাকে ক্বোরবানীর তৌফিক হবে না, সে এ সমস্ত কর্ম করলে ক্বোরবানীর সাওয়াব অর্জন করে নিবে।
(বাহারে শরীয়ত, হিসসা: 15, পৃষ্ঠা: 330, প্রকাশিত দা'ওয়াতে ইসলামী)
মুফারসিরে ক্বোরআন হাকীমুল উম্মত হযরত মুফতী আহমদ ইয়ার খাঁন নাঈমী রহমতুল্লাহি তা'আলা আলাইহি বলেছেন:
"বরং যে ক্বোরবানি করতে পারে না সেও এ "আশরা " (যিলহজ্জ মাসের প্রথম দশ দিন) ক্ষৌরকর্ম করাবে না; বরং ক্বোরবানির ঈদের দিন নামাযের পর ক্ষৌরকর্ম করলে ইনশা-আল্লাহ সাওয়াব পাবে। কিছু সংখ্যক বর্ণনায় এমনই রয়েছে।
(মিরআতুল মানাজীহ শারহে মিশকাতুল মাসাবীহ (বাংলা), খন্ড: 2, পৃষ্ঠা: 446, টীকা: 14)
والله اعلم بالصواب
ইতি
✍️ মুফতী গুলজার আলী মিসবাহী
🌎হেমতাবাদ, রায়গঞ্জ, উত্তর দিনাজপুর, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।🌎
29/11/1443 হিজরী
30/06/2022 খ্রিষ্টাব্দ
🪐রোজ- বৃহস্পতিবার
Comments -