কারবালা কেন্দ্রিক প্রচলিত ইমাম বাড়া তৈরি করা, সেখানে ফাতিহা ও মান্নত করার বিধান
কারবালা কেন্দ্রিক প্রচলিত ইমাম বাড়া তৈরি করা, সেখানে ফাতিহা করা ও তার জন্য মান্নত করার বিধান
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ ।
প্রশ্ন:- কি বলেন ওলামায়ে কেরাম এ মাসআলা প্রসঙ্গে যে, কারবালা কেন্দ্রিক প্রচলিত ইমাম বাড়া তৈরি করা, সেখানে গিয়ে ফাতিহা করা ও তার জন্য মান্নত করা জায়েয আছে কি না? বিস্তারিত বর্ণনা করুন, প্রতিদান দেয়া হবে।
الجواب بعون الملك الوهاب اللھم ھدایة الحق والصواب
উত্তর:- কারবালা কেন্দ্রিক প্রচলিত ইমাম বাড়া তৈরি করা, সেখানে গিয়ে ফাতিহা করা ও তার জন্য মান্নত করা, এসব কর্ম নাজায়েয ও গুনাহ।
হুযূর আ'লা হাযরাত রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহু বলেন:
"কারবালা কেন্দ্রিক প্রচলিত ইমাম বাড়ার ঘর (বানানো) বিদ'আত ও নিষিদ্ধ" ملخصا (ফাতাওয়া রাযাবীয়াহ, খন্ড: 24, পৃষ্ঠা: 497, প্রকাশিত: রেযা একাডেমী, মুম্বাই)
আর এক জায়গায় বলেন:
"ইমাম বাড়ার জন্য ওয়াক্বফ (দান) হতে পারে না। সেটা যে বানিয়েছে তারই মালিকানা রয়েছে। তার অধিকার আছে তাতে যা চাইবে করবে। আর সে না থাকলে তার ওয়ারিসদের মালিকানা হবে, তাদের অধিকারে থাকবে।" (ফাতাওয়া রাযাবীয়াহ, খন্ড: 16, পৃষ্ঠা: 122, প্রকাশিত: রেযা একাডেমী, মুম্বাই))
হুযূর বাহরুল উলূম রহমতুল্লাহি আলাইহিকে প্রশ্ন করা হয় যে, "ইমাম বাড়া -এর নামে একটি জমি আছে, তাতে কি মসজিদ নির্মাণ করা অথবা (মসজিদ থাকলে তাকে) চওড়া করা যাবে?
এর উত্তরে হুযূর বাহরুল উলূম হাযরাত আল্লামা মাওলানা মুফতী আব্দুল মান্নান আ'যমী রহমতুল্লাহি তা'আলা আলাইহি বলেন:
"ওয়াক্বফ (দান) সঠিক হওয়ার জন্য দু'টি শর্ত রয়েছে। (১) ওয়াক্বফ কারীর দৃষ্টিতেও সেই কর্ম নেকীর কাজ হবে। (২) সেই কর্ম ইসলাম ধর্মের দৃষ্টিতেও নেকীর কাজ হবে। আর ইমাম বাড়া তৈরি করা ওয়াক্বফ কারীর দৃষ্টিতে নেকীর কাজ হতে পারে; কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিতে শুরু হতে শেষ পর্যন্ত গুনাহের কাজ।" (ফাতাওয়া বাহরুল উলূম, খন্ড: 5, পৃষ্ঠা:39-40, প্রকাশিত: শাব্বির ব্রাদার্স, লোহার)
ফাতাওয়া মারকাযে তারবিয়্যাতে ইফতা নামক কিতাবে রয়েছে-
" বানোয়াট কারবালা, ইমাম বাড়া এবং কাল্পনিক রওযা তৈরি করে তাকে ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহুর রওযা মনে করা, অতঃপর তার সাথে হাযরাত ইমাম (হুসাইন -এর) পবিত্র রওযা মুবারকের মতো ব্যবহার করা হল হারাম ও গুনাহ। বুদ্ধিমান ব্যক্তি খুব ভালো করে জানে যে, কাল্পনিক রওযা কোন মতেই হাযরাত ইমামের রওযা নয়। না সেটা কারবালা, না সেটা ইমামের বারগাহ অথবা শয়ন কক্ষ। তারপরেও তার সাথে প্রকৃত ইমাম (হুসাইন -এর) রওযার মতো ব্যবহার করা কেমন করে জায়েয হতে পারে? ইসলাম কাল্পনিক ও বানোয়াট বস্তুকে প্রকৃত এবং সত্য (হিসেবে) মেনে নেয়ার শিক্ষা দেয় না। সাধারণ মানুষের এই নিয়মটি (ইমাম বাড়া তৈরি করা) সম্পুর্ণ ভুল এবং তাকে ইমামে হুসাইন -এর রওযা মনে করে সেখানে ফাতিহা পাঠ কারী এবং তার অন্যান্য কর্মসমূহ পালন কারীরা হল গুনাহগার। (ফাতাওয়া মারকাযে তারবিয়্যাতে ইফতা, খণ্ড: 2, পৃষ্ঠা: 374, প্রকাশিত: ফাক্বীহে মিল্লাত একাডেমী, আওঝাগঞ্জ, বসতী)
ফাতাওয়া বাদরুল ওলামা -এর মধ্যে রয়েছে-
"বানোয়াট কবরের জিয়ারত করা হারাম। এবং হাদীসের মধ্যে ধিক্কার এসেছে। ফাতাওয়া আযীযিয়াহ -এর মধ্যে রয়েছে-
لعن الله من زار بلا مزار
অর্থাৎ:- যে ব্যক্তি বিনা মাযারে বা কবরে জিয়ারত করে তার উপর আল্লাহ পাক অভিশাপ করেছেন।
যে বুযরুগের মাযার থাকার দাবি করবে সে শারয়ী দলীল দ্বারা প্রমাণ করবে। বিনা শরয়ী দলীলে মাযার বানানোও নাজায়েয ও গুনাহ।" (ফাতাওয়া বাদরুল ওলামা, পৃষ্ঠা: 306, প্রকাশিত: রেযা একাডেমী)
হুযূর বাহরুল উলূম রহমতুল্লাহি তা'আলা আলাইকে প্রশ্ন করা হয় যে," (লোকেরা) ইমাম বাড়া -এ মুরগা দেয় এবং ফাতিহাও করে। বাড়িতে থাকাকে লোক খারাপ মনে করে। এর উত্তর ক্বোরআন ও হাদীস অনুযায়ী দিবেন।"
এর উত্তরে হুযূর বাহরুল উলূম হাযরাত আল্লামা মাওলানা মুফতী আব্দুল মান্নান আ'যমী রহমতুল্লাহি তা'আলা আলাইহি বলেন:
"ইমাম বাড়া অথবা তাজিয়াদারি সব নাজায়েয। এজন্য সেখানে ফাতিহা করা নাজায়েয। শোহাদায়ে কারবালা رضوان الله علیہم اجمعین -এর ফাতিহা বাড়িতে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন জায়গায় করতে হয়।"
"হাযরাত শাহ আব্দুল আযীয সাহেব মুহাদ্দিস দেহেলবী বলেন:
"فاتحہ درود جائے باید خواند کہ پاک باشد از نجاست ظاہری و معنوی"
হাযরাত শাহ সাহেব আলাইহির রহমা ইমাম বাড়াকে গুপ্ত অপবিত্র জায়গা বলেছেন এবং সেখানে ফাতিহা করতে নিষেধ করেছেন।"
(ফাতাওয়া বাহরুল উলূম, খন্ড:5, পৃষ্ঠা:446, প্রকাশিত: শাব্বির ব্রাদার্স, লোহার))
হুযূর ফাক্বীহে মিল্লাত রহমতুল্লাহি তা'আলা আলাইহি বলেন:
"ইমাম বাড়া অথবা তাজিয়ার সামনে শিরনী ইত্যাদি রেখে ফাতিহা করা জায়েয নেই।" (ফাতাওয়া ফাইযূর রাসূল, খন্ড: 2, পৃষ্ঠা: 564)
যেহেতু ইমাম বাড়া তৈরি করা ও সেখানে গিয়ে ফাতিহা করা নাজায়েয সেহেতু তার জন্য মান্নত করাও নাজায়েয। যদি কেউ মান্নত করেই ফেলে, তাহলে পূর্ণ করা যাবে না। কারণ, নাজায়েয কর্মের মান্নত পূর্ণ করা হারাম। আর এটা মনে করা যে, মান্নত পূর্ণ না করলে কোন ক্ষতি হবে, সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।
হাদীস শরীফে রয়েছে-
عَنْ عِمْرَانَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا نَذْرَ فِي غَضَبٍ
অনুবাদ:- হাযরাত ইমরান ইব্নে হুসায়ন রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, নাজায়েয কাজে কোন মান্নত নেই।
(সুনানে নাসাঈ, খন্ড: 2, পৃষ্ঠা: 128)
আর এক হাদীসে রয়েছে-
عَنْ عَائِشَةَ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ مَنْ نَذَرَ أَنْ يُطِيعَ اللهَ فَلْيُطِعْهُ وَمَنْ نَذَرَ أَنْ يَعْصِيَهُ فَلاَ يَعْصِهِ
অনুবাদ:- হাযরাত আয়েশা রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহা সূত্রে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণিত রয়েছে, তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি এরুপ মান্নত করে যে, সে আল্লাহ্র আনুগত্য করবে, সে যেন আল্লাহ্র আনুগত্য করে। আর যে মান্নত করে যে, সে আল্লাহ্র না-ফরমানী করবে, সে যেন তাঁর না-ফরমানী না করে।
(সহীহ বুখারী, খন্ড: 2, পৃষ্ঠা: 991, প্রকাশিত: মাজলিসে বারকাত, জামেয়া আশরাফিয়া মুবারকপুর)
উক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় মুফারসিরে ক্বোরআন হাকীমুল উম্মত হাযরাত আল্লামা মাওলানা মুফতী আহমদ ইয়ার খাঁন নাঈমী রহমতুল্লাহি তা'আলা আলাইহি বলেন:
"মনে রাখা উচিত যে, খোদ যে কর্মটি গুনাহ, তার মান্নত করাই সঠিক নয়। যেমন- মদ খাওয়া, জুয়া খেলা ও অহেতুক কোন মুসলমানকে হত্যা করার মান্নত। এরুপ মান্নত সমূহ হল বাতিল। তা পূর্ণ করা হারাম।" (মিরআতুল মানাজীহ (উর্দু) খন্ড: 5, পৃষ্ঠা: 234, প্রকাশিত: নাঈমী কুতুব খানা, গুজরাট)
আ'লা হাযরাত রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুকে প্রশ্ন করা হয় যে, যায়েদ তাজিয়ার কাছে গিয়ে এ মান্নত করল যে, আমি এখান থেকে একটি খুরমা নিয়ে যাচ্ছি। যদি আমার কাজ (আশা) পূর্ণ হয়, তাহলে আগামী বছর চাদীর মতো সাদা খুরমা তৈরি করে দিব। (এ মান্নত কি গ্ৰহণযোগ্য হবে)?
এর উত্তরে তিনি বলেন: "এ মান্নত সম্পূর্ণরুপে বাতিল এবং নাজায়েয।" (ফাতাওয়া রাযাবীয়াহ, খন্ড: 24, পৃষ্ঠা: 502, প্রকাশিত: রেযা একাডেমী, মুম্বাই)
যেরুপভাবে প্রচলিত তাজিয়া বানানো নাজায়েয এবং তার জন্য মান্নত করা বাতিল ও নাজায়েয; অনুরূপভাবে ইমাম বাড়া বানানোও নাজায়েয এবং তার জন্য মান্নত করাও বাতিল ও নাজায়েয।
উপরোক্ত দলীল সমূহ দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে, ইমাম বাড়া তৈরি করা, তাতে গিয়ে ফাতিহা করা ও তার কাছে ছাগল ও মুরগা ইত্যাদি দেয়ার মান্নত করা এসব কর্মকাণ্ড নাজায়েয ও গুনাহ। সুতরাং উক্ত কাজ থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যিক। যতদূর সম্ভব বাড়িতে অথবা যে কোনো পরিস্কার জায়গায় ইমাম হুসাইন রাদিআল্লাহু তা'আলা আনহু এবং অন্যান্য শহীদগণের নামে ফাতিহা-মিলাদের আয়োজন করুন এবং তাঁদের পথে চলার চেষ্টা করুন, এতেই কল্যাণ রয়েছে।
والله تعالى اعلم و رسوله اعلم بالصواب عز و جل و صلى الله عليه وسلم
ইতি
✍️মুফতী গুলজার আলী মিসবাহী
🌍হেমতাবাদ, রায়গঞ্জ, উত্তর দিনাজপুর।
শিক্ষক: মাদ্রাসা গৌসিয়া ফাসীহিয়া মাদীনাতুল উলূম (সোসাইটি) খালতিপুর, কালিয়াচক, মালদা, পশ্চিম বঙ্গ, ভারত।🌍
14/12/1443 হিজরী
14/07/2022 খ্রিষ্টাব্দ
রোজ- বৃহস্পতিবার
স্বীকৃতি প্রদানকারী ✅
সঠিক উত্তর হয়েছে।
(ফাক্বীহে বাঙ্গাল, মুফতী) মুহাম্মদ আলীমুদ্দিন রেজবী মাযহারী, জঙ্গিপুরী, মুর্শিদাবাদ।
সভাপতি: জামেয়া গাওসিয়া রেজবীয়া, গাড়িঘাট, রঘুনাথগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গ।
শিক্ষক- নাইত শামসেরিয়া হাই মাদ্রাসা (উচ্চ মাধ্যমিক)
গাড়ীঘাট,রঘুনাথগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ।
স্বীকৃতি প্রদানকারী ✅
উত্তরটি খুব সুন্দর এবং সঠিক হয়েছে। লেখক নিজ প্রচেষ্টায় সফল হয়েছে। আল্লাহপাক লেখককে দীর্ঘায়ু করুন এবং বেশি বেশি ধর্মীয় খেদমত করার তৌফিক দিন। আমীন সুম্মা আমীন।
ইতি
(আযীযে মিল্লাত, মুফতী) আব্দুল আজিজ কালিমী।
ইমামঃ 5তলা জামে মসজিদ, কালিয়াচক, মালদা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
শিক্ষক: মাদ্রাসা গৌসিয়া ফাসীহিয়া মাদীনাতুল উলূম (সোসাইটি) খালতিপুর, কালিয়াচক, মালদা।
স্বীকৃতি প্রদানকারী ✅
মুফতি গুলজার আলী মিসবাহী সাহেবের লেখা উপরোক্ত ফতোয়াটি পাঠ করলাম,
উক্ত বিষয়টি হল মুহররম পালন সংক্রান্ত বর্তমান সময়ের অতি প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়, তিনি আকাবিরে আহলে সুন্নাত -এর মতামত পেশ করে বিষয়টি খুব সুন্দর ও সঠিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ পেশ করেছেন।
আল্লাহ তা'আলা লেখকের কলমে আরও শক্তি প্রদান করুন এবং সমস্ত মুসলমানদের উপরোক্ত মাস'আলাটির উপর আমল করার তৌফিক দান করুন! আমীন!
ইতি
(মুফতী) আমজাদ হুসাইন সিমনানী, দক্ষিণ দিনাজপুর।
প্রিন্সিপাল: মাদ্রাসা জামিয়া নুরীয়া হিফজুল কুরআন, সুকানদিঘী, আমিনপুর, কুশমুন্ডী, দক্ষিণ দিনাজপুর।
Comments -